Sunday, April 12, 2020

মাতৃভাষা, তোমাকে শুভ নববর্ষ


অবিরত দেখাদেখি মেইল মেসেঞ্জারের যুগে
হালখাতাটা পোড়ালে মোবাইলটা ভাংলে
হাত ধোয়াধোয়িতে যদি উবে যেতো
আগের বছরের ছোয়াছোয়ি উৎসব
আগামী বছরের তাহলে আর দরকার পড়তো না

ফ্রান্সে এখন মাঝামাঝি এপ্রিল
বাংলাদেশে চৈত্র গড়াতে গড়াতে
চাদপুরের সেই বুড়োবুড়ি জেলে জেলেনির সাথে
খুব জমেছিলো ক'বছর আগের এক বৈশাখে
সদরঘাটের কাছাকাছি শ্যামবাজার বুড়িগঙ্গা পারে

বুড়োর মাথায় গামছার বিড়া
বুড়ির পরনে সাদার ওপর
ছোপ ছোপ ছাপা তাতের হলদেটে শাড়ি
ধুলায় ধুলায় তাতে হাজার বছরের কমলাভা
ফুলিয়া শান্তিপুরি বেগমপুরি বালুচরি
মটকা মসলিন জামদানি স্বর্নচরি শাটিপাটি ইতিহাস   

সামনে ম্যালা টুকরিতে রাই শর্ষে মাখা নকশী ইলিশ
দুজনের কপালের ভাজে মৌসুমের এসরাজ
বুড়োর পাকালো হাটুতে গোটানো লুঙ্গি
লাল চেক হাফ হাতা সবুজ শার্টে  হাওয়াই  মিঠাই বোলে
দাড়িতে হাত বুলায়ে শেখালো নদীজল মশলার খ্যালা
সে-মৌতাতে সারেঙ্গী বাজাতে পারে শুধু বাংলা বর্ণমালা

হাজংয়ের প্যাক খ্যালা আর সাওতালের ধিতাং
আদিবাসের সব মন্ত্র ঝপাং ঝপাং একত্র খরতালে
বুড়ির পাশে রাখা পিতলের পানদান থেকে বেরোলো
ছোট্ট এক সুপারি কাটার যাতি
চুন আর খয়েরের কৌটা
আঙ্গুলগুলোর গিটে কোমড়া ফুলের মাচা
পানি বাড়লে বানজলে বেদে বেদেনীদের বাচা

দুইজন একের বাক্য আরেকে কেড়েকুড়ে
চোখের পানসা মনিতে বৈঠাভাতি নেড়েচেড়ে
জানালো তাজা ও শুটকির মাঝামাঝি এক পুরানা কারিগরি
ফ্রিজ বিদ্যুৎ লাগবে না এমনই সে মাছের দিকদারি
বোঝালো পদ্মার ইলিশগুলো মোটালো ও দুধসাদা
মেঘনার সরু ইলিশের পেট লাল আর পিঠে পাবো নীলা

গল্পকথকথায় উত্তেজিত আবার ধাধায় থতোমতো
কিভাবে বুঝবো কোনটা পদ্মা আর কোনটা মেঘনা
স্বর ও ব্যাঞ্জনের মৌরসীপাট্টা
আর নকশীচেরা কাটাকাটির ভোকাট্টায়
নদীর ফারাক ধরতে পারবো কি পারবো না
আত্মছন্দের তুফানে ওড়াবো সোয়াদের নজরানা

পাঠক, আপনি ভাবছেন,
বুড়োবুড়ি কি আর আমার পাচমিশালি বুঝতে পারছিলো
জানায়ে রাখি ঐ দুজন ছিলো মাছের প্রমিতে এলেমদার
আমদের সকলের  মাতৃপিতৃকুল কিন্তু মাছের সওয়ার

সওয়াল জবাবে বুড়ো জানালো,
'দ্যাখেন, আমি ইচ্ছা করে ছায়াতে বসি নাই
পানরসে টইটুম্বুর বুড়ি কাটলো টিপ্পনী,
'চৈতি রোদে মেঘনার মাছের বাড়ে খোলতাই'
আমিতো 'কৈ যাই কৈ যাই'

বুড়োবুড়িকে পেয়েছিলো গল্পের নেশায়
রহস্যরসে বুড়ো সাবন্তসারং ত্রিতাল ঢঙ্গে বল্লো,
'মেঘনার মাছগুলো কিন্তু আপনের ধরনে লম্বা
চাদপানা বাকাতে
তেরছাকাটা নকশী কাটতে খুব সুবিধা
তবে খুব সময় নিয়ে ধীরে ধীরে কাটতে হয়'
দরদাম মুলায়ে পোষালে
মসলামাখা ইলিশ কাস্টমার বাড়ি নিয়ে যায়
এক ছাত্র মানুষ বলে গেলো,
'বরাতজোরে ইলিশ হয়ে জন্মাই নাই'
সখিস্বভাবি হিজড়া দুলালো ট্যাসেলের পরচুলা
আমাদের বুড়ি থেকে পান চুন খেয়ে চড়া সুরে গাইলো,
'বেহেন্দি জালে বান্ধিয়া আম সরিষার কাসুন্দি মাখিয়া
ও বাবু ইলিশ লিজিয়ে, ও বিবি ইলিশ লিজিয়ে'
বুড়ি চেচালো, 'পান দিলাম জানি তোরে, এইবার যা'

চারদিকের হুলুস্থুলু হঠাৎ থেমে গেলো
লঞ্চ স্টিমারের হুটোপুটি কুলিদের চিৎকার
যাত্রীদের পড়িমরি সবকিছুতে পিনপতন নীরবতা
হয়তো থামে নাই কিন্তু থামি থামি থমকানো ঠেকলো
কালবৈশাখী যেভাবে হবার কথা সেভাবেই শুরু হলো

ফ্রান্সে চ্যানেল পারে এবং বাংলাদেশের জলজংলাহাওরে
ঘর ফেরতা শ্রমিকেরা শত মাইল হেটে পথে পেলো বরফ
ওখানে বরফ* থাকার কথা ছিলো না
বরফ জমাটের আগে আকাশে ঘনালো কালো
ওখানে কালো* থাকার কথা ছিলো না
অনেক দুরের আলো বেলাবেলি পৃথিবীতে পৌছালো
যেভাবে পৌছানোর কথা ছিলো ঠিক ঠিক  সেভাবে

একই স্বভাবে ইলিশকুমারি ও ইলিশকুমারদের কেউ কেউ
রূপকল্পের কলকাঠি এড়ায়ে জেলেদের জাল গলে
অনলাইন রোগতত্ব আর সংখ্যার উপাত্ত
ছাপায়ে একে অন্যকে সুধায়েছিলো
চোদ্দশো সাতাশের আগমনী তত্ত্ব :
সার্ফিং-ফ্যানামাখা সদ্য শেখা বাংলায়
তুমুল সব ঢেউ তোলা বিস্ফারিত বুদবুদে বলেছিলো
মাতৃভাষা, তোমাকে শুভ নববর্ষ
মাতৃভাষা, তোমাকে বার বার শুভ নববর্ষ


চয়ন খায়রুল হাবিব
২৯শে চৈত্র, ১৪২৬
১২/০৪/২০
ব্রিটানি, ফ্রান্স

*মাহমুদুল হকের 'কালো বরফ' উপন্যাস সূত্রে।
কভার, ঢাকাতে ১৪২৭ বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে না করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের কারণে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ একটি পোস্টার ছেপেছে স্মারক হিশেবে।